দেবী তুলসী সম্পর্কে বিধি-নিষেধ... 📚
সকালে সূর্যোদয়ের আগে কিংবা সন্ধায় সূর্যাস্তের পরে, এবং দ্বাদশী তিথিতে কখন ও তুলসীপত্র চয়ন করতে নেই। আগের কিংবা সকালে তোলা তুলসীপত্র শুখিয়ে গেলেও, তা শ্রীবিগ্রহ অর্চ্চনায় ব্যবহার করা চলে।
সকালে ভক্তের উচিত্ কয়েকটি তুলসী গাছ রাখা। তবে খুব সতর্কতার সাথে এগুলোর যত্ন করতে হবে। কারণ তুলসী কৃষ্ণ প্রেয়সী। তুলসী গাছ গুলো এমন যায়গায় রাখতে হবে যাতে মানুষ অথবা পশু তাঁর উপর দিয়ে হেঁটে যেতে না পারে, তাঁকে দুমরে মুচরে দিতে না পারে। মঞ্জরী গুলো কচি সময় হাত দিয়ে (নখ দিয়ে নয়) ভেঙ্গে দিলে গাছ্টি অত্যন্ত সুস্থও সবল ভাবে বেরে উঠবে।
শ্রীমতী তুলসীদেবীর যাতে কোনও প্রকার ব্যথা সৃষ্টি না হয়, সেই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হতে হয়। ডান হাত দিয়ে তাঁর পত্র চয়ণের সময়ে বামহাত দিয়ে শাখাটিকে ধরে রাখতে হয় যাতে সেটি ভেঙ্গে না যায়। তুলসী পত্র চয়ণের শেষে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়।
শুধুমাত্র বিষ্ণুতত্ত্ব বিগ্রহসমূহ ও চিত্রপটসমূহের প্রতি তুলসী চরণে তুলসী চরণে নিবেদন করা যায় না। ভগবানকে ভোগ নিবেদনের সময় প্রত্যেক সামগ্রীতে একটি করে তুলসী পাতা বা মঞ্জরী দিতে হয়।
🎆 শ্রীগোবিন্দের চরণ ব্যতীত তুলসীপত্র অর্পণ করতে নেই
গুরুদেব ভগবানের মতো শ্রদ্ধেয় হলেও তিনি কখনই ভগবান নন৷ তিনি ভগবানের প্রিয় সেবকমাত্র৷ তিনি ভগবানের ভক্ত৷ আর তুলসী হচ্ছেন গোবিন্দবল্লভা৷ শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী। একমাত্র বিষ্ণুতত্ত্ব ব্যতীত কারও চরণে তুলসীপত্র অর্পণ করা কখনই উচিত নয়, কারণ তা মহা অপরাধ। শ্রীঅনন্ত সংহিতা শাস্ত্রে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে-
তুলস্যা বিষয়ং তত্ত্বং বিষ্ণুমেব সমর্চয়েৎ ৷
সা দেবী কৃষ্ণশক্তিহি শ্রীকৃষ্ণবল্লভা মতা ৷৷
অতস্তাং বৈষ্ণবীং দেবীং নান্যপদে সমর্পয়েৎ ৷
অর্পণে তত্ত্বহানিংঃ স্যাৎ সেবাপরাধ এব চ ৷৷
অতত্ত্বজ্ঞস্ত পাষণ্ডো গুরুব্রুবস্য পাদয়োঃ ৷
অর্পয়ন্ তুলসীং দেবীমর্জয়েন্নরকং পদম্ ৷৷
“তুলসীপত্র দিয়ে শ্রীবিষ্ণু তত্ত্বের অর্চনা করা কর্তব্য। তুলসীদেবী কৃষ্ণশক্তি, শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা। তিনি পরম বৈষ্ণবী। অন্য কারও পদে তুলসীপত্রাদী অর্পণ করা উচিত নয়৷ যদি কেউ অর্পণ করে তবে সে তত্ত্বজ্ঞানহীন হয় এবং তার সেবা অপরাধ হয়৷ আর যে তত্ত্বজ্ঞানহীন পাষণ্ড গুরুদেবের চরণে তুলসী অর্পণ করে তার নরকগতিই লাভ হয়৷”
যে ব্যক্তি চরণে তুলসীপত্র গ্রহণ করে সে কখনই গুরু নয়৷ সে পরমগুরুরত্ত বিরােধী৷ ভগবান শ্রীহরি ছাড়া কোনও দেবদেবীকে তুলসীপত্র দিয়ে কখনই অর্চনা করা উচিত নয়। বায়ুপুরাণে মহর্ষি ব্যাসদেব সেই কথা উল্লেখ করেছেন
তুলসীদল মাত্রায় যোহন্যং দেবং প্রপূজয়েৎ ৷
ব্রহ্মহা স হি গোঘ্নশ্চ স এব গুরুতল্পগঃ ৷৷
“যে ব্যক্তি তুলসীপত্র দ্বারা অন্য দেবদেবীর পূজা করে তার নিশ্চয়ই ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা ও গুরুপত্নী গমনের পাপ অর্জিত হয়ে থাকে৷”
🔯 শ্রী শ্রী তুলসী আরতি
নমো নমঃ তুলসী ! কৃষ্ণপ্রেয়সী ৷
রাধাকৃষ্ণ-সেবা পাব এই অভিলাসী ৷৷
যে তোমার শরণ লয়, তার বাঞ্ছা পূর্ণ হয়,
কৃপা করি কর তারে বৃন্দাবন বাসী ৷
মোর এই অবিলাস, বিলাস-কুঞ্জে দিও বাস,
নয়নে হেরিব সদা যুগলরূপরাশি ৷৷
এই নিবেদন ধর, সখীর অনুগত কর,
সেবা অধিকার দিয়ে কর নিজ দাসী ৷
দীন কৃষ্ণদাসে কয়, এই যেন মোর হয়,
শ্রীরাধাগোবিন্দ প্রেমে সদা যেন ভাসী ৷৷
🔯 তুলসী-প্রদক্ষিণ মন্ত্রঃ
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।
তানি তানি প্রনশ্যন্তি প্রদক্ষিণ পদে পদে ॥
অর্থঃ যখন মানুষ শ্রীমতী তুলসীদেবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, তখন প্রতি পদক্ষেপে তার কৃত সকল পাপকর্ম, এমন কি ব্রহ্মহত্যার পাপও বিনষ্ট হয়ে যায়। তারপরে বাঁ হাতে পষ্ণপাত্র ধারণ করে তা থেকে ডান হাত দিয়ে শ্রীমতি তুলসীদেবীকে জল সিষ্ণন করতে হয়।
তুলসী দর্শনে পুন্য
স্পর্শে পাপ নাশ
স্মরণে তীর্থ লাভ
ভক্তিতে মুক্তি লাভ
🔯 তুলসী প্রণাম মন্ত্রঃ
ওঁ বৃন্দায়ৈ তুলসী দৈব্যৈ
প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ ।
বিষ্ণুভক্তি প্রদে দেবী
সত্যবত্যৈ নমো নমঃ ॥
🔯 তুলসী জলদান মন্ত্রঃ
ওঁ গোবিন্দবল্লভাং দেবীং ভক্তচৈতন্যকারিণীম্ ।
স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনীম্ ॥
🔯 তুলসী চয়ন মন্ত্রঃ
ওঁ তুলস্যমৃতজন্মাসি সদা ত্বং কেশবপ্রিয়া ।
কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে ॥
দেবী তুলসী বৈদিক যুগ থেকে সনাতন ধর্মে অন্যতম স্তরে প্রাধান্য পেয়ে আসছেন। তাই তাকে গৃহে প্রতিস্থাপন করে পবিত্রতা বিস্তার করুণ।
তুলসী পাতা এতই পবিত্র যে, এটি একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ঞুর পাদপদ্দ ব্যতীত অন্য কোন দেবতা বা দেবীর চরনে তুলসীপাতা অর্ঘ্য হিসাবে দেয়া যায় না। অবশ্য লক্ষ্মীদেবীর পুজোয় তুলসী পাতার প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সকল দেবতা দেবী পূজোর ভোগে তুলসী পাতা ও মঞ্জুর অত্যাবশ্যক। তুলসী পাতা ভিজানো জল ছটা গৃহাদি পবিত্র করনের কাজে ব্যবহার করা হয়। গভীর ধর্মীয় আঙ্গিকে হিন্দু সমাজে তুলসী গাছের এতো মহিমা প্রচার করে এবং তদানুযায়ী এর পূজন ও যত্ন করা হয়।
এখন দেখা যাক বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক ব্যাখ্যায় তুলসীগাছ বিষয়ে কি বলা আছে –
তুলসী (Tulsi/Holy Basil/ thai Krapho) একটি Lamiaceae family এর অন্তর্গত সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum (sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) । হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণত হিন্দু পরিবারে কৃষ্ঞ ও রাধা তুলসী এই দুই প্রকারে প্রাপ্ত তুলসী হিন্দু গৃহে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে। এর পিছনে গভীর রয়েছে ধর্মীয়,পরিবেশগত ও বৈজ্ঞানিক কারণ ।
ধর্মীয় কারণ :
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তুলসীকে সীতাস্বরূপা, স্কন্দপুরাণে লক্ষীস্বরূপা, চর্কসংহিতায় বিষ্ণুর ন্যায় ভুমি, পরিবেশ ও আমাদের রক্ষাকারী বলে বিষ্ঞু প্রিয়া, ঋকবেদে কল্যাণী বলা হয়েছে । স্বয়ং ভগবান বিষ্ঞু, তুলসীদেবীকে পবিত্রাবৃন্দা বলে আখ্যায়িত করে এর সেবা করতে বলেছেন।
পরিবেশগত কারণ :
সাধারণতঃ উদ্ভিদ মাত্র দিনে অক্সিজেন ও রাতে কার্বডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তুলসীগাছ একমাত্র উদ্ভিদ যা দিন ও রাত চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে বায়ু বিশুদ্ধ রাখে। যেখানে অন্য যেকোন গাছ রাত্রিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে তাই রাতের বেলাতে তুলসীতলায় শয়ন করাও ব্যক্তির জন্য উপকারী। এছাড়া তুলসীগাছ ভুমি ক্ষয় রোধক এবং তুলসী গাছ লাগালে মশা কীটপতঙ্গ ও সাপ থেকে দূরে রাখে।
বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত কারণ:
তুলসীতে Eugenolঅধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitorরূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
• Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
• তেজস্ক্রিয়তার ফেলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।
• চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।
• তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals(যেমন oleanolic acid ,beta caryophyllene ইত্যাদি)বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সািয় ব্যবহৃত হয়।
• তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
• তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।
• শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ,হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।
• সর্দি ,কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
• দাঁতের রোগে উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
তুলসীর গুণাগুণ আমাদের এই উপমহাদেশে যারা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র চর্চা করেন তাদের কাছে তুলসীর গুণাগুণকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। তুলসীর সিদ্ধ পানি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তুলসী কেবল শরীরকে নয় বরং শরীরের সাথে এটি বাতাসকেও দূষণমুক্ত করে। তুলসী পাতার অনেক গুণ রযেছে৷ আয়ুর্বেদে তুলসীকে ভেষজের আখ্যা দেওয়া হয়৷ চলুন এই ভেষজের গুণগুলো জেনে নিই৷
* জ্বর হলে জলের মধ্যে তুলসী পাতা, গোল মরিচ এবং মিশ্রী মিশিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করুন৷ অথবা তিনটে দ্রব্য মিশিয়ে বড়ি তৈরি করুন৷ দিনের মধ্যে তিন-চার বার ঐ বড়িটা জলের সঙ্গে খান৷ জ্বর খুব তাড়াতাড়ি সেরে যাবে৷
* কাশি যদি না কমে সেই ক্ষেত্রে তুলসী পাতা এবং আদা পিষে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খান৷… এতে উপকার পাবেন৷
* পেট খারাপ হলে তুলসীর ১০ টা পাতা সামান্য জিরের সঙ্গে পিষে ৩-৪ বার খান৷ পায়খানা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে৷
* মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে দিনে ৪-৫ বার তুলসী পাতা চেবান৷
* ঘা যদি দ্রুত কমাতে চান তাহলে তুলসী পাতা এবং ফিটকিরি একসঙ্গে পিষে ঘা এর স্থানে লাগান কমে যাবে৷
* শরীরের কোন অংশ যদি পুড়ে যায় তাহলে তুলসীর রস এবং নারকেলের তেল ফেটিয়ে লাগান এতে জ্বালা কমবে৷ পোড়া জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে৷ সেখানে কোন দাগ থাকবে না৷
* ত্বকের চমক বাড়ানোর জন্য এছাড়া ত্বকের বলীরেখা এবং ব্রোনো দূর করার জন্য তুলসী পাতা পিষে মুখে লাগান৷
* বুদ্ধি এবং স্মরণ শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ৫-৭ টা তুলসী পাতা চিবান৷
* প্রস্রাবে জ্বালা হলে তুলসী পাতার রস ২৫০ গ্রাম দুধ এবং ১৫০ গ্রাম জলের মধ্যে মিশিয়ে পান করুন৷ উপকার পাবেন৷
* ত্বকের সমস্যা দূর করতে তিল তেলের মধ্যে তুলসী পাতা ফেলে হালকা গরম করে ত্বকে লাগান৷
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আদি ঋষিরা দেব সাধনায় ধ্যানস্হ থাকতেন বলে আমরা জানি। এসব ঋষিদের ধারনা গত পদ্ধতি গুলি একটিই হলো হিন্দু পরিবার গুলো তুলসী পুজো বা তুলসী সেবা। আসলে ঐ সব আদি ঋষিরা গবেষনা করতেন, যাকে আমরা ধ্যান বলছি। সত্যি সত্যি ভাবতে অবাক লাগে আমরা যে সময়টাকে জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য অনগ্রসর বলি, সে সময়টায় এরা তুলসী গাছের এতো গুন আবিস্কার করে। সাধারণ মানুষ যেহেতু অতি সহজে কোন নির্দেশ মানতে রাজী হয় না, হয়তঃ সেকারণে ঐসব মনিষীরা তুলসী গাছ পরিচর্যার জন্য ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের বিষয়টি নিয়ে এসেছেন বলেই হিন্দু শাস্ত্রাদিতে বলা হয়েছে – “যারা প্রত্যহ তুলসীর দর্শন, স্পর্শন, ধ্যান, গুণ কীর্তন, প্রণাম, গুণশ্রবন, রোপন, জল প্রদান ও পূজা এই নয় প্রকারে তুলসীর ভজনা করেন তারা সহস্র কোটি যুগ পর্যন্ত বিষ্ঞুলোকে বসতি লাভ করেন”।
সকালে সূর্যোদয়ের আগে কিংবা সন্ধায় সূর্যাস্তের পরে, এবং দ্বাদশী তিথিতে কখন ও তুলসীপত্র চয়ন করতে নেই। আগের কিংবা সকালে তোলা তুলসীপত্র শুখিয়ে গেলেও, তা শ্রীবিগ্রহ অর্চ্চনায় ব্যবহার করা চলে।
সকালে ভক্তের উচিত্ কয়েকটি তুলসী গাছ রাখা। তবে খুব সতর্কতার সাথে এগুলোর যত্ন করতে হবে। কারণ তুলসী কৃষ্ণ প্রেয়সী। তুলসী গাছ গুলো এমন যায়গায় রাখতে হবে যাতে মানুষ অথবা পশু তাঁর উপর দিয়ে হেঁটে যেতে না পারে, তাঁকে দুমরে মুচরে দিতে না পারে। মঞ্জরী গুলো কচি সময় হাত দিয়ে (নখ দিয়ে নয়) ভেঙ্গে দিলে গাছ্টি অত্যন্ত সুস্থও সবল ভাবে বেরে উঠবে।
শ্রীমতী তুলসীদেবীর যাতে কোনও প্রকার ব্যথা সৃষ্টি না হয়, সেই বিষয়ে বিশেষ যত্নবান হতে হয়। ডান হাত দিয়ে তাঁর পত্র চয়ণের সময়ে বামহাত দিয়ে শাখাটিকে ধরে রাখতে হয় যাতে সেটি ভেঙ্গে না যায়। তুলসী পত্র চয়ণের শেষে ক্ষমা প্রার্থনা করতে হয়।
শুধুমাত্র বিষ্ণুতত্ত্ব বিগ্রহসমূহ ও চিত্রপটসমূহের প্রতি তুলসী চরণে তুলসী চরণে নিবেদন করা যায় না। ভগবানকে ভোগ নিবেদনের সময় প্রত্যেক সামগ্রীতে একটি করে তুলসী পাতা বা মঞ্জরী দিতে হয়।
🎆 শ্রীগোবিন্দের চরণ ব্যতীত তুলসীপত্র অর্পণ করতে নেই
গুরুদেব ভগবানের মতো শ্রদ্ধেয় হলেও তিনি কখনই ভগবান নন৷ তিনি ভগবানের প্রিয় সেবকমাত্র৷ তিনি ভগবানের ভক্ত৷ আর তুলসী হচ্ছেন গোবিন্দবল্লভা৷ শ্রীকৃষ্ণের প্রেয়সী। একমাত্র বিষ্ণুতত্ত্ব ব্যতীত কারও চরণে তুলসীপত্র অর্পণ করা কখনই উচিত নয়, কারণ তা মহা অপরাধ। শ্রীঅনন্ত সংহিতা শাস্ত্রে পরিষ্কার উল্লেখ রয়েছে-
তুলস্যা বিষয়ং তত্ত্বং বিষ্ণুমেব সমর্চয়েৎ ৷
সা দেবী কৃষ্ণশক্তিহি শ্রীকৃষ্ণবল্লভা মতা ৷৷
অতস্তাং বৈষ্ণবীং দেবীং নান্যপদে সমর্পয়েৎ ৷
অর্পণে তত্ত্বহানিংঃ স্যাৎ সেবাপরাধ এব চ ৷৷
অতত্ত্বজ্ঞস্ত পাষণ্ডো গুরুব্রুবস্য পাদয়োঃ ৷
অর্পয়ন্ তুলসীং দেবীমর্জয়েন্নরকং পদম্ ৷৷
“তুলসীপত্র দিয়ে শ্রীবিষ্ণু তত্ত্বের অর্চনা করা কর্তব্য। তুলসীদেবী কৃষ্ণশক্তি, শ্রীকৃষ্ণের প্রিয়তমা। তিনি পরম বৈষ্ণবী। অন্য কারও পদে তুলসীপত্রাদী অর্পণ করা উচিত নয়৷ যদি কেউ অর্পণ করে তবে সে তত্ত্বজ্ঞানহীন হয় এবং তার সেবা অপরাধ হয়৷ আর যে তত্ত্বজ্ঞানহীন পাষণ্ড গুরুদেবের চরণে তুলসী অর্পণ করে তার নরকগতিই লাভ হয়৷”
যে ব্যক্তি চরণে তুলসীপত্র গ্রহণ করে সে কখনই গুরু নয়৷ সে পরমগুরুরত্ত বিরােধী৷ ভগবান শ্রীহরি ছাড়া কোনও দেবদেবীকে তুলসীপত্র দিয়ে কখনই অর্চনা করা উচিত নয়। বায়ুপুরাণে মহর্ষি ব্যাসদেব সেই কথা উল্লেখ করেছেন
তুলসীদল মাত্রায় যোহন্যং দেবং প্রপূজয়েৎ ৷
ব্রহ্মহা স হি গোঘ্নশ্চ স এব গুরুতল্পগঃ ৷৷
“যে ব্যক্তি তুলসীপত্র দ্বারা অন্য দেবদেবীর পূজা করে তার নিশ্চয়ই ব্রহ্মহত্যা, গো-হত্যা ও গুরুপত্নী গমনের পাপ অর্জিত হয়ে থাকে৷”
🔯 শ্রী শ্রী তুলসী আরতি
নমো নমঃ তুলসী ! কৃষ্ণপ্রেয়সী ৷
রাধাকৃষ্ণ-সেবা পাব এই অভিলাসী ৷৷
যে তোমার শরণ লয়, তার বাঞ্ছা পূর্ণ হয়,
কৃপা করি কর তারে বৃন্দাবন বাসী ৷
মোর এই অবিলাস, বিলাস-কুঞ্জে দিও বাস,
নয়নে হেরিব সদা যুগলরূপরাশি ৷৷
এই নিবেদন ধর, সখীর অনুগত কর,
সেবা অধিকার দিয়ে কর নিজ দাসী ৷
দীন কৃষ্ণদাসে কয়, এই যেন মোর হয়,
শ্রীরাধাগোবিন্দ প্রেমে সদা যেন ভাসী ৷৷
🔯 তুলসী-প্রদক্ষিণ মন্ত্রঃ
যানি কানি চ পাপানি ব্রহ্মহত্যাদিকানি চ।
তানি তানি প্রনশ্যন্তি প্রদক্ষিণ পদে পদে ॥
অর্থঃ যখন মানুষ শ্রীমতী তুলসীদেবীকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে, তখন প্রতি পদক্ষেপে তার কৃত সকল পাপকর্ম, এমন কি ব্রহ্মহত্যার পাপও বিনষ্ট হয়ে যায়। তারপরে বাঁ হাতে পষ্ণপাত্র ধারণ করে তা থেকে ডান হাত দিয়ে শ্রীমতি তুলসীদেবীকে জল সিষ্ণন করতে হয়।
তুলসী দর্শনে পুন্য
স্পর্শে পাপ নাশ
স্মরণে তীর্থ লাভ
ভক্তিতে মুক্তি লাভ
🔯 তুলসী প্রণাম মন্ত্রঃ
ওঁ বৃন্দায়ৈ তুলসী দৈব্যৈ
প্রিয়ায়ৈ কেশবস্য চ ।
বিষ্ণুভক্তি প্রদে দেবী
সত্যবত্যৈ নমো নমঃ ॥
🔯 তুলসী জলদান মন্ত্রঃ
ওঁ গোবিন্দবল্লভাং দেবীং ভক্তচৈতন্যকারিণীম্ ।
স্নাপয়ামি জগদ্ধাত্রীং কৃষ্ণভক্তি প্রদায়িনীম্ ॥
🔯 তুলসী চয়ন মন্ত্রঃ
ওঁ তুলস্যমৃতজন্মাসি সদা ত্বং কেশবপ্রিয়া ।
কেশবার্থে চিনোমি ত্বাং বরদা ভব শোভনে ॥
দেবী তুলসী বৈদিক যুগ থেকে সনাতন ধর্মে অন্যতম স্তরে প্রাধান্য পেয়ে আসছেন। তাই তাকে গৃহে প্রতিস্থাপন করে পবিত্রতা বিস্তার করুণ।
তুলসী পাতা এতই পবিত্র যে, এটি একমাত্র পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ঞুর পাদপদ্দ ব্যতীত অন্য কোন দেবতা বা দেবীর চরনে তুলসীপাতা অর্ঘ্য হিসাবে দেয়া যায় না। অবশ্য লক্ষ্মীদেবীর পুজোয় তুলসী পাতার প্রয়োজন হয় না। এছাড়া সকল দেবতা দেবী পূজোর ভোগে তুলসী পাতা ও মঞ্জুর অত্যাবশ্যক। তুলসী পাতা ভিজানো জল ছটা গৃহাদি পবিত্র করনের কাজে ব্যবহার করা হয়। গভীর ধর্মীয় আঙ্গিকে হিন্দু সমাজে তুলসী গাছের এতো মহিমা প্রচার করে এবং তদানুযায়ী এর পূজন ও যত্ন করা হয়।
এখন দেখা যাক বৈজ্ঞানিক ও প্রায়োগিক ব্যাখ্যায় তুলসীগাছ বিষয়ে কি বলা আছে –
তুলসী (Tulsi/Holy Basil/ thai Krapho) একটি Lamiaceae family এর অন্তর্গত সুগন্ধি জাতীয় উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম Ocimum sanctum (sanctum অর্থ পবিত্র স্থান) । হাজার হাজার বছর ধরে সাধারণত হিন্দু পরিবারে কৃষ্ঞ ও রাধা তুলসী এই দুই প্রকারে প্রাপ্ত তুলসী হিন্দু গৃহে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়ে আসছে। এর পিছনে গভীর রয়েছে ধর্মীয়,পরিবেশগত ও বৈজ্ঞানিক কারণ ।
ধর্মীয় কারণ :
ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে তুলসীকে সীতাস্বরূপা, স্কন্দপুরাণে লক্ষীস্বরূপা, চর্কসংহিতায় বিষ্ণুর ন্যায় ভুমি, পরিবেশ ও আমাদের রক্ষাকারী বলে বিষ্ঞু প্রিয়া, ঋকবেদে কল্যাণী বলা হয়েছে । স্বয়ং ভগবান বিষ্ঞু, তুলসীদেবীকে পবিত্রাবৃন্দা বলে আখ্যায়িত করে এর সেবা করতে বলেছেন।
পরিবেশগত কারণ :
সাধারণতঃ উদ্ভিদ মাত্র দিনে অক্সিজেন ও রাতে কার্বডাইঅক্সাইড ত্যাগ করে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে তুলসীগাছ একমাত্র উদ্ভিদ যা দিন ও রাত চব্বিশ ঘণ্টা অক্সিজেন সরবরাহ করে বায়ু বিশুদ্ধ রাখে। যেখানে অন্য যেকোন গাছ রাত্রিতে কার্বন ডাই অক্সাইড ত্যাগ করে তাই রাতের বেলাতে তুলসীতলায় শয়ন করাও ব্যক্তির জন্য উপকারী। এছাড়া তুলসীগাছ ভুমি ক্ষয় রোধক এবং তুলসী গাছ লাগালে মশা কীটপতঙ্গ ও সাপ থেকে দূরে রাখে।
বৈজ্ঞানিক ও স্বাস্থ্যগত কারণ:
তুলসীতে Eugenolঅধিক পরিমাণে থাকায় তা Cox-2 Inhibitorরূপে কাজ করে বলে তা ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
• Hypoglycemic drugs এর সাথে তুলসী খেলে তা টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে দেয়।
• তেজস্ক্রিয়তার ফেলে ক্ষতিগ্রস্থ কোষসমুহকে মেরামত করে।
• চর্বিজনিত হৃদরোগে এন্টি অক্সিডেন্টের ভুমিকা পালন করে।
• তুলসী একশেরও বেশি Phytochemicals(যেমন oleanolic acid ,beta caryophyllene ইত্যাদি)বহন করে বলে ক্যান্সার চিকিত্সািয় ব্যবহৃত হয়।
• তুলসীর অ্যালকোহলিক নির্যাস Immune system এর রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতাকে বৃদ্ধি করে।
• তুলসী স্নায়ুটনিক ও স্মৃতিবর্ধক।
• শ্বসনতন্ত্রের বিভিন্নরোগ যেমন ব্রঙ্কাইটিস, ইনফ্লুয়েঞ্জা ,হাঁপানি প্রভৃতি রোগের নিরাময়ক।
• সর্দি ,কাশি, জ্বর, বমি, ডায়ারিয়া, কলেরা, কিডনির পাথর, মুখের আলসারসহ চোখের বিভিন্ন রোগে ইহা ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
• দাঁতের রোগে উপশমকারী বলে টুথপেস্ট তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।
তুলসীর গুণাগুণ আমাদের এই উপমহাদেশে যারা আয়ুর্বেদ শাস্ত্র চর্চা করেন তাদের কাছে তুলসীর গুণাগুণকে নতুন করে ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। তুলসীর সিদ্ধ পানি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। তুলসী কেবল শরীরকে নয় বরং শরীরের সাথে এটি বাতাসকেও দূষণমুক্ত করে। তুলসী পাতার অনেক গুণ রযেছে৷ আয়ুর্বেদে তুলসীকে ভেষজের আখ্যা দেওয়া হয়৷ চলুন এই ভেষজের গুণগুলো জেনে নিই৷
* জ্বর হলে জলের মধ্যে তুলসী পাতা, গোল মরিচ এবং মিশ্রী মিশিয়ে ভাল করে সেদ্ধ করুন৷ অথবা তিনটে দ্রব্য মিশিয়ে বড়ি তৈরি করুন৷ দিনের মধ্যে তিন-চার বার ঐ বড়িটা জলের সঙ্গে খান৷ জ্বর খুব তাড়াতাড়ি সেরে যাবে৷
* কাশি যদি না কমে সেই ক্ষেত্রে তুলসী পাতা এবং আদা পিষে মধুর সঙ্গে মিশিয়ে খান৷… এতে উপকার পাবেন৷
* পেট খারাপ হলে তুলসীর ১০ টা পাতা সামান্য জিরের সঙ্গে পিষে ৩-৪ বার খান৷ পায়খানা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে৷
* মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে দিনে ৪-৫ বার তুলসী পাতা চেবান৷
* ঘা যদি দ্রুত কমাতে চান তাহলে তুলসী পাতা এবং ফিটকিরি একসঙ্গে পিষে ঘা এর স্থানে লাগান কমে যাবে৷
* শরীরের কোন অংশ যদি পুড়ে যায় তাহলে তুলসীর রস এবং নারকেলের তেল ফেটিয়ে লাগান এতে জ্বালা কমবে৷ পোড়া জায়গাটা তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যাবে৷ সেখানে কোন দাগ থাকবে না৷
* ত্বকের চমক বাড়ানোর জন্য এছাড়া ত্বকের বলীরেখা এবং ব্রোনো দূর করার জন্য তুলসী পাতা পিষে মুখে লাগান৷
* বুদ্ধি এবং স্মরণ শক্তি বাড়ানোর জন্য প্রতিদিন ৫-৭ টা তুলসী পাতা চিবান৷
* প্রস্রাবে জ্বালা হলে তুলসী পাতার রস ২৫০ গ্রাম দুধ এবং ১৫০ গ্রাম জলের মধ্যে মিশিয়ে পান করুন৷ উপকার পাবেন৷
* ত্বকের সমস্যা দূর করতে তিল তেলের মধ্যে তুলসী পাতা ফেলে হালকা গরম করে ত্বকে লাগান৷
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আদি ঋষিরা দেব সাধনায় ধ্যানস্হ থাকতেন বলে আমরা জানি। এসব ঋষিদের ধারনা গত পদ্ধতি গুলি একটিই হলো হিন্দু পরিবার গুলো তুলসী পুজো বা তুলসী সেবা। আসলে ঐ সব আদি ঋষিরা গবেষনা করতেন, যাকে আমরা ধ্যান বলছি। সত্যি সত্যি ভাবতে অবাক লাগে আমরা যে সময়টাকে জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য অনগ্রসর বলি, সে সময়টায় এরা তুলসী গাছের এতো গুন আবিস্কার করে। সাধারণ মানুষ যেহেতু অতি সহজে কোন নির্দেশ মানতে রাজী হয় না, হয়তঃ সেকারণে ঐসব মনিষীরা তুলসী গাছ পরিচর্যার জন্য ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্যের বিষয়টি নিয়ে এসেছেন বলেই হিন্দু শাস্ত্রাদিতে বলা হয়েছে – “যারা প্রত্যহ তুলসীর দর্শন, স্পর্শন, ধ্যান, গুণ কীর্তন, প্রণাম, গুণশ্রবন, রোপন, জল প্রদান ও পূজা এই নয় প্রকারে তুলসীর ভজনা করেন তারা সহস্র কোটি যুগ পর্যন্ত বিষ্ঞুলোকে বসতি লাভ করেন”।
0 Comments